"প্রাণদাতা"
তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
_______________
বাড়িটা দেখেই বুকের মধ্যে কেমন ছাৎ করে উঠেছিল। জরাজীর্ণ অবস্থা। সামনের গেটটা কেউ
খুলে নিয়ে গেছে। চারিদিকে আগাছার জঙ্গল। এই বাড়িতে থাকতে হবে? মনটা কিরকম কু গেয়ে
উঠল। কিন্তু কী-ই বা করব! প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। আমার পছন্দের থােড়াই পরােয়া করেন
মালিকরা। এই বাড়ি ভেঙে কারখানা তৈরি হবে। আপাতত বাড়ি ভাঙার তদারকি করাই আমার
কাজ। সেইজন্যই এখানে আসা। অবশ্য একা নই। সঙ্গে এসেছে আমার বেয়ারা-কাম-কুক রামদেও।
শক্তিমান এক ভােজপুরী।
একটা ঘর পছন্দ করে সংসার পাতলাম। রামদেও গেল রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করতে। আমি হাত
লাগালাম খাট, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি সাজাতে-গােছাতে। জায়গাটার নাম কির্নাহার, রামপুরহাটে নেমে
চোদ্দ কিলােমিটার বাসে যেতে হয়। লাল মাটির দেশ।
সব সাজিয়ে-গুছিয়ে দোতলার বারান্দায় সবে চেয়ার পেতে বসেছি, এমন সময় রামদেও হাজির।
কাচুমাচু মুখে কী যেন বলতে চায়।
‘কিরে রামদেও, কিছু বলবি?
রামদেও বলে, ‘জী হাঁ বাবু, ইয়ে মােকান ঠিক নেহি হ্যায়। ও লােগ বিগড় যায়েগা।
হাে হাে করে আমি হেসে উঠি, ‘ও লােগ? তার মানে ভূত? তা বেশ তাে, টিভি-ফিভি নেই,
নাহয় ফ্রিতে কিছু ভূতই দেখা যাবে। কি বলিস?
আমার কথাটা বােধহয় রামদেওর পছন্দ হল না। মুখ ভার করে চা আনতে চলে গেল।
চা খাওয়া তখন আমাদের শেষ হয়নি, হঠাৎ রান্নাঘরের দিক থেকে বিকট ঝনঝন
আওয়াজ। চায়ের কাপ হাতেই রামদেও ছুটল, পিছনে পিছনে আমি। গিয়ে দেখি বাসনপত্র
সব ছত্রাকার। রামদেওকে ধমক দিয়ে বললাম, এত অসাবধান কেন তুই? নিশ্চয়ই বেড়াল ঢুকে
এই কাণ্ড করেছে।
‘বিল্লি ! লেকিন ঘুষেগা ক্যায়সে? খিড়কি-কেওয়াড়ি হমনে খুদ লগা দিয়া। বিস্মিত রামদেও
বলে।
তবে কি ভূত? আবার একটু ধমক দিই, যা, সব উঠিয়ে রেখে রাতের রান্নাটা চাপিয়ে
দে।
সময়টা শীতকাল। রাতের খাওয়া সেরে একটা আলােয়ান নিয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছি।
চাদর মুড়ি দিয়ে রামদেও পাশেই বসে আছে। একথা-ওকথার পর ঠাট্টার সুরে বলি, “কিরে রামদেও,
তাের ভূতগুলাে গেল কোথায়? ডাক। কমসে কম একটাকে তাে দেখে যাই।
রামদেও বলে, ‘মজাক কা বাত নেহি হ্যায় বাবু। জরুর কুছ হ্যায় ইসি মােকানমে। আপ
বিসােয়াস করে ইয়া নেহি, লেকিন এহি সাচ হ্যায়। সে আরও বলে, হামি কুছ প্রেত-বিদ্যা
জানি। হামার গলায় এই যে তাবিজ আছে, ইস লিয়ে কোই আমাকে কুছু করতে পারবে না।
লেকিন আপকে লিয়ে হামার বহুৎ ডর লাগছে। এক কাম করে, আজ রাত হামলােগ একহি কামরামে
শো যায় ?
প্রথমে ভাবলাম রাজি হয়ে যাই ওর প্রস্তাবে। পরে মনে হল, ভয়কে প্রশ্রয় দিলে আমি হয়তাে
ছােট হয়ে যাব ওর চোখে। তাই বললাম, না না, তার দরকার হবে না। তুই এক কাজ করিস,
রাতে একটু সজাগ থাকিস। তাহলেই হবে। তারপর কাল সকাল থেকেই তাে এই বাড়ি ভাঙার
কাজ শুরু হবে। তখন না হয় ডেরাডাণ্ডা উঠিয়ে...'।
আমার মুখের কথা তখনও ফুরােয়নি, বাড়ি কাপিয়ে কে যেন হাে হাে করে হেসে উঠল। অনেকক্ষণ
ধরে গােটা বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল সেই হাসি। আমার হাত-পা পাথরের
মতাে ঠান্ডা আর ভারী হয়ে উঠল। কোনােরকমে ভয় কাটিয়ে রামদেওকে বললাম, “কোনাে পাগল-
টাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে বােধহয় আশেপাশে।
রাত কত কে জানে। হঠাৎ একটা ঝকানিতে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল কে যেন
খাটটাকে ধরে প্রচণ্ড জোরে নাড়াচ্ছে। চোখ খুলে হারিকেনের অল্প আলােয় দেখি খাটের
পাশে দাঁড়িয়ে আছে অল্পবয়সী একটি মেয়ে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। মেয়েটি ইশারায়
দরজা দেখাচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতাে দরজার দিকে এগােলাম। চমক ভাঙল খিলে হাত পড়তেই।
একি! খিল তাে বন্ধই রয়েছে, তাহলে মেয়েটি বন্ধ ঘরে ঢুকল কি করে! দড়াম করে দরজা
খুলেই চেঁচিয়ে উঠি, রামদেও ! রামদেও!' রামদেও সজাগই ছিল। আমার আর্ত চিৎকার শুনে ও
লাফিয়ে বেরিয়ে এল নিজের ঘর থেকে। দেখলাম ওর হাতে একটা কাগজের মােড়ক। চেঁচিয়ে
উঠল রামদেও, ‘বাবুজী, আগে মাৎ বাঢ়না। এ লােগ প্রেত আছে। সামনে তাকিয়ে দেখি মেয়েটির
সঙ্গে একজন লােকও রয়েছে, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ভারিক্কি চেহারার। আমাদের দেখে লােকটা
দাঁতে দাঁত চেপে গজরাল, বাড়ি ভাঙবি? এত সাহস! আয়, আজ তােদেরই ভেঙে গুঁড়াে
গুঁড়াে করি।
মুহূর্তের মধ্যে রামদেও তার মােড়ক থেকে মুঠো করে ধুলাের মতাে কি যেন নিয়ে বিড়বিড়
করে মন্ত্র পড়তে পড়তে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিল। ওদের চেহারাটা ঝাপসা দেখাল। পরক্ষণেই মেয়েটির
তীক্ষ্ণ চিৎকার, বাণ মারবি? আয়, আয় দেখি তােদের কত শক্তি!
আমার কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কি দেখছি, কি শুনছি, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। রামদেও
আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আমাকে ঠেলতে থাকে, ‘হােস মাৎ খাে না বাবুজী। গেটকা তরফ ভাগিয়ে।
নেহি তাে এ লােগ হামে মার ডালে গা।
ছুটতে ছুটতে যখন বাড়ি থেকে মাঠে নেমেছি, তখন ওরা ওদের কৌশল বদলাল। দেখি দুজনের
শরীর থেকে দুটো সাদা কঙ্কাল বেরিয়ে এল। হি হি করে হাসতে হাসতে কঙ্কাল দুটো আমাদের
দিকে এগিয়ে আসছে। রামদেও আবার তার মন্ত্রপূত ধুলাে ছুঁড়ল। এবার একটা কঙ্কাল চার-পাঁচটা
হয়ে রামদেওকে পাশ কাটিয়ে আমাকে ঘিরে ধরল। রামদেও তখন একটানে নিজের গলা থেকে
তাবিজটা ছিড়ে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলে উঠল, “বাবু, ইয়ে মুঠঠিমে পাকড়কে রাখনা। ভাগিয়ে
বড়া মন্দির কা তরফ, জলদি ভাগিয়ে।
কতক্ষণ দৌড়েছি মনে নেই। একটা বাড়ির আলাে দেখে তাদের দরজার ওপর আছড়ে
পড়লাম। জ্ঞান হতে দেখি আমাকে ঘিরে চার-পাঁচটা উদ্বিগ্ন মুখ। এক বৃদ্ধা স্নেহভরা স্বরে
জিজ্ঞাসা করলেন, ঠিক আছ তাে বাবা ? মাথা নাড়ি, জল চাই। জল খাবার পরে সব কথা
খুলে বলি ওঁদের। বৃদ্ধা শুনে চমকে ওঠেন, কী সর্বনাশ! তুমি সরকার বাড়িতে রাত কাটাতে
গেছ? এ বুদ্ধি তােমায় কে দিল? জান, সন্ধের পর ঐ বাড়ির কাছের রাস্তা দিয়ে কোনাে লােক
চলে না? যাকে তুমি দেখেছ, উনি হচ্ছেন শিবশঙ্কর সরকার। তান্ত্রিক ছিলেন। একবার তন্ত্রসাধনা
করতে গিয়ে ঐ মেয়েটা সমেত অপঘাতে মারা যান। সেই থেকে ঐ বাড়ি মানুষের বসবাসের অযােগ্য
হয়ে গেছে।
হঠাৎ হাতের মুঠোর মধ্যে কবচের কথাটা মনে পড়ে, মনে পড়ে রামদেওর কথা। ওঁদের বলি,
‘দয়া করে আমার সঙ্গে একটু চলুন। আমার এক সঙ্গী ওখানে আটকা পড়ে গেছে।
বৃদ্ধা বললেন, যদি এই গাঁয়ের সব মানুষ একসঙ্গে গেলেও ওকে উদ্ধার করা যেত,
তাহলে আমি আমার ছেলেকে সবার আগে যেতে বলতুম। কিন্তু তা কিছুতেই হবে না, হওয়া
সম্ভব নয়। মাঝখান থেকে গোঁয়ার্তুমি করতে গেলে আরও দু-চার জনের প্রাণ যাবে। তার চেয়ে
সকাল হােক। তখন সবাই তােমার সঙ্গে যাব। তখন নিশাচরদের ক্ষমতা কমে যায়। তুমি এখন
একটু বিশ্রাম কর।
সকাল হতে অনেক লােকজন এসে গেলেন। বুঝলাম এরই মধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে
কাল রাতের ঘটনার কথা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঐ বাড়িতে গেলাম। ভেতরে আর ঢুকতে হল না।
দেখি গেটের সামনেই পড়ে রয়েছে রামদেওর প্রাণহীন দেহ। মাথাটা ঘুরে গেল। অসহায় কান্নায়
ভেঙে পড়লাম আমার প্রাণদাতার নিষ্প্রাণ বুকের ওপর।।
আর ঠিক তখনই হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন আমাকে ব্যঙ্গ করে হেসে উঠল—হাে—
হে -হাে -হাে-হা-হা.....
ও কে ?....কে ও?......কে?
(সমাপ্ত)